পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ Supreme Lord Krishna

 


শ্রীকৃষ্ণই যে পরমেশ্বর ভগবান, তার কোনো  শাস্ত্রীয় প্রমাণ আছে কি? প্রমাণ ছাড়া কাউকে ভগবান বলে মেনে নেওয়া যায় না। অনেকেই মনে করেন, শ্রীকৃষ্ণ একজন মহাপুরুষ ছিলেন, তিনি ভগবান বা ঈশ্বর নন। কেউ কেউ বলেন,  শ্রীকৃষ্ণ বড়জোর ঈশ্বর প্রেরিত একজন দূত ছিলেন, তিনি ঈশ্বর হতে পারেন না। আবার, যেহেতু বৈদিক শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানে ঈশ্বরকে নির্বিশেষ ব্রহ্ম বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাই অনেকেই মত পোষণ করেন, ঈশ্বর আসলে নিরাকার এবং বিভিন্ন দেবদেবীরা বা বিভিন্ন অবতারগণ হচ্ছেন  ঈশ্বরের বিভিন্ন  মূর্তরূপ বা ঈশ্বর সৃষ্ট বিভিন্ন শক্তি এবং শ্রীকৃষ্ণও তাঁদেরই একজন। কিন্তু প্রশ্ন হল, তাদের এই সমস্ত ধারণা সপক্ষে আদৌ কি কোনো শাস্ত্রীয় প্রমাণ আছে? গীতা, ভাগবত বা বেদ-উপনিষদে কোথাও কি বলা হয়েছে যে শ্রীকৃষ্ণ একজন মহাপুরুষ ছিলেন বা তিনি ঈশ্বর-প্রেরিত একজন দূত ছিলেন? না, একেবারেই না। তাহলে  সনাতন শাস্ত্র সমূহে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে ঠিক কি বলা হয়েছে?  যে সকল মহাত্মাগণ শ্রীকৃষ্ণকে  সাক্ষাৎকার করেছিলেন,  তাঁরা কি শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলে মেনে নিয়েছিলেন? অথবা শ্রীকৃষ্ণ নিজে কি কোথাও  স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন যে তিনিই ঈশ্বর? চলুন দেখে নেওয়া যাক~ হরেকৃষ্ণ, মধুবন ব্লগে আপনাকে স্বাগত।

ব্রহ্মসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকেই ব্রহ্মাজী স্বয়ং বলেছেন,
ঈশ্বরঃ পরম: কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দ সর্বকারণকারণম্,।।

    অর্থাৎ সচ্চিদানন্দময় শ্রীকৃষ্ণ,  যিনি গোবিন্দ নামে পরিচিত, তিনিই পরম ঈশ্বর, তিনিই অনাদির আদি এবং তিনিই সমস্ত কারণের পরম কারণ।

শ্রীমদ্ভাগবতে  (১/৩/২৮) বলা হয়েছে,
এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্।
ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে।।

    অর্থাৎ,শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান, সমস্ত অবতারগণ তাঁরই অংশ বা কলা। যুগে যুগে দৈত্য পীড়িত ভুবনকে ইনিই পরিত্রাণের দ্বারা সুখ দিয়ে থাকেন।

অর্থাৎ,  শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর প্রেরিত কোনো দূত বা কোনো অবতার নন বরং তিনি স্বয়ংই ঈশ্বর এবং সমস্ত অবতারগণ তাঁরই অংশ,অর্থাৎ,  তিনিই সমস্ত অবতারের অবতারী। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তিনি নিজেও ঠিক তাই বলেছেন; তিনি বলেছেন (গীতা ১০/২, ১০/৮, ৯/২৪, ৭/৬-৭),

    আমিই সমস্ত দেবদেবীদের উৎস, জড় ও চেতন জগতের সবকিছুর উৎস আমিই, সবকিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়, আমার উর্ধ্বে কিঞ্চিৎ বস্তুও নেই, আমিই সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু। যারা আমার চিন্ময়স্বরূপ জানেনা তারা পুন:পুন সংসার সমুদ্রে অধঃপতিত হয়। আমিই নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও লয়ের কারণ। হে ধনঞ্জয়,  আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ পরমার্থ তত্ত্ব আর কিছু নেই।

এরপর ব্রাহ্মসংহিতায় ( ৫/৩৫) ব্রহ্মাজী আরও বলেছেন,

    শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপত এক তত্ত্ব হয়েও তাঁর  অচিন্তশক্তির মাধ্যমে তিনি অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তাঁর মধ্যেই বর্তমান এবং তিনি যুগপৎ সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণুতেও পূর্ণরূপে অবস্থিত। সেই অনাদিরাদি গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

তিনি আরও বলেছেন,

    প্রভাবশালী এঁরই প্রভা ব্রহ্ম, কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডে যাঁর ক্ষিতি, অপ, প্রভৃতি  বিভূতি পরিব্যাপ্ত  এবং যিনি নিষ্কল, অর্থাৎ,  অখণ্ড, অনন্ত ও অশেষভূত; সেই অনাদিরাদি গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

অর্থাৎ, উপনিষদে যাঁকে নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে সেই নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম  ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই অঙ্গকান্তি। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতেও ঠিক  একই কথা বলা হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের দ্বাদশ অধ্যায়ের একাদশ শ্লোকে বলা হয়েছে,

    ইনিই হচ্ছেন সেই পরম ব্যাক্তি, যাঁকে মহান মুনিঋষিরা নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম বলে জানেন এবং সাধারণ মানুষেরা জড়া প্রকৃতির সৃষ্টি বলেই মনে করেন।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১৪/২৭) ভগবান নিজেও বলেছেন যে, তিনিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা, এমনকি উপনিষদে ঈশ্বরের যে বিরাট রূপের উল্লেখ রয়েছে, সেই বিরাট রূপের আশ্রয়ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। কারণ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ে অর্জুনকে তাঁর বিরাট রূপ দর্শন করিয়েছিলেন। এসব ছাড়াও, অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদে (পূর্ব-১৯) বলা হয়েছে,

    একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনিই আরাধ্য। তিনি এক হয়েও অনন্ত রূপ ও অবতারের মাধ্যমে প্রকাশিত হন।

সেই উপনিষদে আরও বলা হয়েছে (পূর্ব-২২)~

    ব্রহ্মা, যিনি পূর্বকালে জগতে বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেন,  সেই জ্ঞান সৃষ্টির আদিতে যাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত হন,  তিনিই হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। 

সনাতন শাস্ত্র গুলিতে এমন আরও অগনিত প্রমাণ রয়েছে, যা আমাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান। তিনিই পরম তত্ত্ব, তিনিই পরম সত্য। এরপরেও অনেকেই হয়তো বলবেন যে, বৈদিক শাস্ত্রে তো বলা হয়েছে যে, ঈশ্বরের কোনো  জন্ম মৃত্যু নেই, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তো জন্ম গ্রহণ করেছিলেন,  তাঁর পিতামাতা আত্মীয়স্বজন সবাই ছিলেন, এরকম একজন ব্যাক্তি কি করে ঈশ্বর হতে পারেন?  তাঁর কৃপা হলে মধুবনের পরবর্তী ব্লগে আমরা সেই বিষয়ের উপর আলোকপাত করব। হরেকৃষ্ণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ