শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আঠারটি যোগ বা অধ্যায়ে মোট ৭০০ শ্লোক রয়েছে। গীতার অধ্যায়সমূহ যথাক্রমে-(১) অর্জুন বিষাদযোগ, (২) সাংখ্যযোগ, (৩) কর্মযোগ, (৪) জ্ঞানযোগ, (৫) সন্ন্যাসযোগ, (৬) ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ, (৭) জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ, (৮) অক্ষর-ব্রহ্মযোগ, (৯) রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগ, (১০) বিভূতিযোগ, (১১) বিশ্বরূপ-দর্শনযোগ, (১২) ভক্তিযোগ, (১৩) ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ, (১৪) গুণত্রয়-বিভাগযোগ, (১৫) পুরুষোত্তমযোগ, (১৬) দৈবাসুরসম্পদ-বিভাগযোগ, (১৭) শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগযোগ, (১৮) মোক্ষযোগ।
এই আঠারটি অধ্যায়ের মোট ৭০০ শ্লোকের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের উদ্ধৃতিতে ১টি, সঞ্জয়ের উদ্ধৃতিতে ৪০টি, অর্জুনের উদ্ধৃতিতে ৮৫টি এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্ধৃতিতে ৫৭৪টি শ্লোক রয়েছে। এসব শ্লোকের মাধ্যমে মূলত অর্জুনের জিজ্ঞাসু মনের সশ্রদ্ধ প্রশ্ন ও তার প্রেক্ষিতে যথাযোগ্য উত্তর দিতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ভক্তি, প্রেম, আত্মা, জ্ঞান, সকাম-কর্ম, নিষ্কাম-কর্ম, সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্ম প্রভৃতি সম্পর্কিত যাবতীয় দর্শন ও তত্ত্বজ্ঞান উপস্থাপন ও তার বিশ্লেষণ করে অর্জুনের সকল কৌতুহল ও জ্ঞানতৃষ্ণা নিবৃত্ত করেন। এজন্যেই গীতাকে পরম ভক্তি সহকারে সকল শাস্ত্রের সার বলা হয়।
জীবের চূড়ান্ত লক্ষ্য মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে গীতা কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়ে সম্পূর্ণ সাধনতত্ত্ব প্রচার করে। কর্মের সাথে জ্ঞানের এবং জ্ঞানের সাথে ভক্তির সংযোগে সাধনা সম্পূর্ণতা লাভ করে। তবে কর্মযোগই গীতার মুখ্য আলোচ্য বিষয়। কিন্তু এই কর্ম হবে নিষ্কাম কর্ম, অর্থাৎ ফলের আশা না করে কর্ম করে যাওয়া। যেমন-
'কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত¡কর্মণি'।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৪৭)।
অর্থাৎ : কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়। অতএব কর্ম করো। সুতরাং কর্মফল-প্রাপ্তির হেতু হয়ো না। আবার কর্মত্যাগেও তোমার প্রবৃত্তি না হোক (গীতা-২/৪৭)।
কিন্তু কেন এই কর্মফল-প্রাপ্তির হেতু না হয়ে অর্থাৎ কাম্য-কর্ম বাদ দিয়ে কেবল নিষ্কাম কর্ম করে যাওয়া ? শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-
'দূরেণ হ্যবরং কর্ম বুদ্ধিযোগাদ্ ধনঞ্জয়।
বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতবঃ'।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৪৯)।
'কর্মজং বুদ্ধিযুক্তা হি ফলং ত্যক্ত্বা মনীষিণঃ।
জন্মবন্ধবিনির্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্ত্যনাময়ম্'।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৫১)।
অর্থাৎ :
হে ধনঞ্জয়, কাম্য-কর্ম নিষ্কাম-কর্ম অপেক্ষা নিতান্ত নিকৃষ্ট। অতএব তুমি কামনাশূন্য হয়ে সমত্ব বুদ্ধির (সম্যক জ্ঞানের) আশ্রয় গ্রহণ করো। যারা ফলাকাঙ্ক্ষী হয়ে কর্ম করে তারা অতি হীন (গীতা-২/৪৯)। নিষ্কাম কর্মযোগী মনীষিগণ কর্মজাত ফল ত্যাগ করে জন্মরূপ বন্ধন হতে মুক্ত হন এবং সর্বপ্রকার উপদ্রবরহিত (পাপ ও পুণ্য উভয় হতে মুক্ত হয়ে) ব্রহ্মপদ লাভ করেন (গীতা-২/৫১)।
গীতার মতে ফলাসক্তি ও কর্তৃত্বাভিমান বন্ধনের কারণ। আসক্তি ও অহংবুদ্ধি ত্যাগ করে ফলাফলে উদাসীন হয়ে কর্ম সম্পাদনে বন্ধন হয় না। অর্থাৎ সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ করে ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন ও অহংবুদ্ধি বা কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করাই নিষ্কার্ম কর্মের লক্ষণ। কিন্তু আত্মজ্ঞান ব্যতীত এই আসক্তি ও কর্তৃত্বাভিমান দূর হয় না। তাই শ্রীকৃষ্ণ বলেন-
'যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি।
তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ'।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৫২)।
'শ্রুতিবিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস্যতি নিশ্চলা।
সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগমবাপ্স্যসি'।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৫৩)।
অর্থাৎ :
যখন তোমার বুদ্ধি (জ্ঞান) মোহাত্মক অবিবেকরূপ কলুষ অতিক্রম করবে, তখন তুমি শ্রোতব্য ও শ্রুত কর্মফল বিষয়ে বৈরাগ্যলাভ করবে (নিষ্পৃহ হবে) (গীতা-২/৫২)। নানা কর্মফল শ্রবণে বিক্ষিপ্ত তোমার চিত্ত যখন পরমাত্মাতে স্থির ও অচল হবে, তখন তুমি তত্ত্বজ্ঞান লাভ করবে (গীতা-২/৫৩)।
অতএব কর্মযোগ সিদ্ধিলাভের জন্য জ্ঞানলাভের দরকার। আত্মজ্ঞান লাভ হলে ভগবানে পরমভক্তি জন্মায়। এর মাধ্যমেই সমত্ব-বুদ্ধি বা সম্যক-জ্ঞান জন্মায়। এই সমত্ব বুদ্ধিকেই বলা হয় স্থিতপ্রজ্ঞা। গীতায় এই স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি সম্পর্কে শ্রীভগবান বলেন-
'প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনোগতান্ ।
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৫৫)।
দুঃখেষ¦নুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে'।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৫৬)।
অর্থাৎ :
হে পার্থ, বাহ্যলাভে নিরপেক্ষ ও পরমার্থদর্শনে প্রত্যগাত্মাতেই পরিতৃপ্ত হয়ে যখন যোগী সমস্ত মনোগত বাসনা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন, তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলে উক্ত হন (গীতা-২/৫৫)। দুঃখে উদ্বেগহীন, সুখে নিঃস্পৃহ এবং আসক্তিশূন্য ভয়মুক্ত ও ক্রোধরহিত
0 মন্তব্যসমূহ